ঢাকা Friday, 26 April 2024

টিকা আতঙ্কের নেপথ্য কাহিনী

প্রকাশিত: 20:03, 10 June 2021

আপডেট: 20:56, 11 June 2021

টিকা আতঙ্কের নেপথ্য কাহিনী

যদিও কলেরা, পোলিও, ওলাওঠা বসন্ত প্রভৃতি মহামারি ভারতবর্ষের এই অঞ্চলগুলোতে দাপিয়ে বেড়িয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মহামারির বড় ধরনের আঘাতের কথা যদি বলতে হয় তবে সেটা ছিল ১৮৯৮ সালের প্লেগ। এই প্লেগ মহামারির মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁরসহ সন্ন্যাসীরা সেবা করেছিলেন পীড়িতদের। ভগিনী নিবেদিতা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ব্যাধিগ্রস্তদের মৃত্যুমুখ থেকে বাঁচিয়ে তুলতে। সে কথা আমি আমার আরেকটি লেখা ‘মানুষের জন্য মানুষ’-এ বিস্তারিত লিখেছি। 

১৮৯৮ সালের প্লেগ রোগটি আসলে শুরু হয়েছিল মুম্বাই শহরে এবং ক্রমশ এর ঢেউ আছড়ে পড়ে এই বাংলায়। পরবর্তীকালে সেটা মহামারির আকার ধারণ করে। এই মহামারির বিশদ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন বাংলা সাহিত্যের যশস্বী লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তাঁর ‘মহাস্থবির জাতক’ গ্রন্থে। সমকালীন পাঠকবৃন্দের অনেকেরই হয়তো অজানা কী এক অসামান্য উপন্যাস এই ‘মহাস্থবির জাতক’। প্রবীণ পাঠককুলের মধ্যেও কেউ কেউ হয়তো বিস্মৃত হয়েছেন এই গ্রন্থটি সম্পর্কে। প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার বিশাল এই উপন্যাসখানার প্রকাশকাল ১৯৪৫-৪৭। সেকালে উপন্যাসখানা এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল যে, সেসময়কার লেখকদের অনেকের হৃদয়েই সেটা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। বর্তমান সময়ের কিংবদন্তিতুল্য সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কথা প্রসঙ্গে একদিন আমাকে বলেছিলেন - কৈশোরে এই উপন্যাসটি নাকি পড়ে তিনি দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন। ওটা তখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল কোনও একটি পত্রিকায়। সেসময় তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন পরবর্তী কিস্তি পড়ার জন্য। সেসময়কার মহামারির বিশদ বর্ণনা প্রেমাঙ্কুর আতর্থী লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর এই ‘মহাস্থবির জাতক’ উপন্যাসটিতে। যে সময়ের কথা লেখক লিখেছেন সে সময় তিনি বালক মাত্র। কিন্তু স্মৃতি থেকে তিনি যে বর্ণনা দিয়েছেন তা ভয়াবহ। মহাস্থবিরের ভাষ্য অনুযায়ী, প্লেগ ঠেকাতে সেসময় করপোরেশন থেকে বিনামূল্যে টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, টিকার জন্য জনসাধারণের কোনও পয়সা খরচ করতে না হলেও সহজে কেউ টিকা নিতে চাইতো না। বর্তমান সময়ের মতো সেসময়ও ভয়ভীতি ও গুজব নানা ডালপালা বিস্তার করেছিল - এই টিকা নিলে অচিরেই নাকি মানুষের মৃত্যু ঘটবে। এর ফলে যা ঘটার তা-ই ঘটে। রোগটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে চারদিকে। সেকালে শিক্ষাদীক্ষা জ্ঞানবিজ্ঞানে হিন্দু ও মুসলমানদের চেয়ে এগিয়ে ছিল ব্রাহ্মসমাজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ আলোকিত মানুষ ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের প্রতিভূ। ফলশ্রুতিতে দেখা গেল ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী মানুষজনই সর্বপ্রথম টিকা নিতে এগিয়ে আসেন।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল প্রায় ১৪ মাস পূর্বে। তখন পৃথিবীর তাবৎ লোকজন কায়মনো বাক্যে শুধু কামনা করতো কবে আবিষ্কৃত হবে একটি কার্যকরী টিকা। টিকার জন্য মানুষের হা হুতাশের কোনও সীমা-পরিসীমা ছিল না। অথচ প্রায় বছরখানেক পরে যখন একটি-দুটি নয়, পরপর বেশকটি টিকা আবিষ্কৃত হলো ঠিকই কিন্তু দেখা যাচ্ছে অনেকের মধ্যেই টিকা নেয়ার প্রতি রয়েছে কিছুটা অনীহা ও আস্থার অভাব। যেহেতু আমার কিছুটা ইতিহাসচর্চা আছে সেজন্য আমি জানি যে, নতুন যে কোনও জিনিসের প্রতিই মানুষের ঈষৎ ভয় ও অনীহা কাজ করে সবসময়। সে কারণেই আমি বিখ্যাত লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতক’ উপন্যাসটি থেকে ১৮৯৮ সালে মানুষের টিকা নেয়ার ঘটনাটি এখানে তুলে ধরেছি। তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, একশ বছরের বেশি সময় পরেও বেশিরভাগ মানুষের মনমানসিকতার আসলে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি।

তবে এ কথাও সত্য যে, এতগুলো মানুষের ভয়ভীতি ও অনীহাকেও এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমি অনেক ভেবেচিন্তে টিকা আতঙ্কের কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছি। কারণগুলোর মধ্যে প্রথমত, সাধারণ মানুষ এটা খুব ভালো করেই জানে যে, যে কোনও একটি টিকা আবিষ্কার বেশ কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। একটি টিকা সাধারণত দু-তিন বছরের আগে তৈরি করা বেশ দুরূহ। কোনও কোনও টিকা আবিষ্কারে তো দশ-বিশ বছর সময়ও লেগে যায়। কিন্তু কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে বছর ঘোরার আগেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ভালো করে শেষ হতে না হতেই টিকা তৈরি। বর্তমানে বাংলাদেশে যে টিকাটি দেয়া হচ্ছে সেটার নাম অ্যাস্ট্রাজেনেকা আর এটার আবিষ্কারক অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানী ড. সারাহ গিলবার্ট। সারাহর নেতৃত্বে অক্সফোর্ডের একদল বিজ্ঞানী জানুয়ারি মাস থেকেই ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন। সারাহ ও তাঁর দলের সংক্রমণজনিত রোগের ভ্যাকসিন তৈরির পূর্বাভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে এই টিকা আবিষ্কারের পূর্বে ইবোলা রোগের টিকাও তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু ইবোলা রোগের টিকা আবিষ্কারেও তার দু-বছর সময় লেগেছিল।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিটিশ সরকার ও ব্রিটেনের কয়েকটি দাতব্য সংস্থার অর্থায়নে ২০০৫ সালে গড়ে তোলা হয় জেনার ইনস্টিটিউট। উদ্দেশ্য - সংক্রমণজনিত রোগ নিয়ে গবেষণা আর টিকা তৈরি। এডওয়ার্ড জেনারকে বলা হয় ভ্যাকসিনের জনক। প্রায় ২০০ বছর আগে গুটিবসন্তের টিকার অন্যতম আবিষ্কারক ছিলেন বিজ্ঞানী জেনার। গুটিবসন্তের টিকা আবিষ্কার করে থেমে থাকেননি তিনি। জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে এই টিকার আওতায় নিয়ে আসতে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।

এই মুহূর্তে আমার আরেক প্রাতঃস্মরণীয় বিজ্ঞানীর নাম মনে পড়ছে যিনি দু-দুটি টিকা আবিষ্কার করে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। উনিশ শতকের শেষ ভাগে ওয়ালডেমার মোরডেকাই হাফকিন প্যারিস ও ভারতবর্ষে গবেষণা চালিয়ে কলেরা ও প্লেগ রোগের প্রথম ভ্যাকসিন তৈরি করেছিলেন; কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বসন্তের টিকা আবিষ্কারক ডা. এডওয়ার্ড জেনার কিংবা তারপরে পোলিও রোগের ভ্যাকসিন আবিষ্কারক জোনাস সাল্কর মতো ওয়ালডেমার হাফকিন ভারতে কিংবা ইউরোপে তেমন একটা পরিচিতি পাননি। দীর্ঘদিন কলেরার জীবাণু নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানী হাফকিন প্যারিসে গিনিপিগের ওপর পরীক্ষায় সাফল্যের পর খরগোশ ও কবুতরের ওপর একই ধরনের পরীক্ষা চালান। এরপরও সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট হলেন না হাফকিন। ১৮৯২ সালের ১৮ জুলাই ইনজেকশনের মাধ্যমে নিজের দেহে সেই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রায় মরতে বসেছিলেন বলা চলে। সম্ভবত ডোজের পরিমাণ বেশি হয়ে গিয়েছিল। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে বেশ কয়েকদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। পরে অবশ্য সেরে ওঠেন। হাফকিনের কথা যেহেতু উঠলই সেহেতু মহান মানবতাবাদী এই বিজ্ঞানীর কথা একটু বলা প্রয়োজন।

ওয়ালডেমার হাফকিন একজন রাশিয়ান ইহুদি, তিনি কাজ শুরু করেছিলেন ওডেসা শহরে। পরে প্যারিসে গিয়ে আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সে সময়টাতে অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে লোকের মনে ছিল ঘোর সন্দেহ। আঠারোশো চুরানব্বই সালের বসন্তকাল। ওয়ালডেমার হাফকিন হাজির হলেন ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায়। বসন্তকাল ছিল কলেরার মৌসুম। তিনি মনে করছিলেন, এ সময়টাতে তিনি শহরে কলেরার প্রকোপ দেখতে পাবেন। এর আগের বছর মার্চ মাসে তিনি প্রথম ভারতে এসেছিলেন। তার সঙ্গে ছিল এমন এক ভ্যাকসিন, যেটা দিয়ে তিনি আশা করছিলেন কলেরা প্রতিরোধ সম্ভব হবে। কিন্তু ভারতে পৌঁছানোর পর তিনি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হন। ভারতের মাটিতে পা রাখার প্রথম দিন থেকেই ব্রিটিশ ভারতের মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ জনগণ তাঁর টিকা নিয়ে সন্দেহ করতে থাকে, তাঁর কাজে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। কারণ তিনি কোনও ডাক্তার নন, তিনি ছিলেন একজন প্রাণিবিজ্ঞানী।

যুগে যুগে নানা ধরনের টিকা আবিষ্কারের ফলে কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে, একথা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি ভুল টিকা আবিষ্কার কিংবা প্রয়োগের ফলে নিশ্চিত মৃত্যু ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শত সহস্র সাধারণ জনগণ। বড় ধরনের টিকা বিপর্যয়ের ইতিহাস পাওয়া যায় আমেরিকায়, ১৯৭৬ সালে। সেসময় সোয়াইন ফ্লু-র বিস্তার রোধে যে টিকা দেয়া হয়েছিল সেটা ছিল ত্রুটিযুক্ত। সেসময় প্রায় সাড়ে চার কোটি লোককে টিকা দেয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৪৫০ জন মানুষ ‘গুইলাইন ব্যারে সিনড্রোম’ (Guillain-Barre Syndrome)-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। অনেকে হয়তো ভাবছেন এই গুইলাইন ব্যারে সিনড্রোম আবার কী বস্তু! এটা হলো এমন এক রোগ যা একজন মানুষের নার্ভ সিস্টেমকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। ফলশ্রুতিতে সোয়াইন ফ্লু টিকা নেয়া মানুষগুলো পক্ষাঘাতে (Paralysis) আক্রান্ত হয়েছিল। প্রতি এক লাখ রোগীর মধ্যে একজন করে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এর পূর্বেও যে টিকা বিপর্যয়ের কথা জানা যায় সেটা হলো ‘দ্য কাটার ইনসিডেন্ট’। পোলিওর এই টিকাটি তৈরি হয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়ার কাটার ল্যাবরেটরিতে। ১৯৫৫ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার পশ্চিম ও মধ্য পশ্চিমাঞ্চলে প্রায় দু-লক্ষ শিশুকে এই কাটার পোলিও টিকা দেয়া হয়। কিন্তু এই টিকাটি এতটাই ত্রুটিযুক্ত ছিল যে, এই দু-লক্ষ শিশুর মধ্যে চল্লিশ হাজার শিশু পোলিওতে আক্রান্ত হয়েছিল। দু-শতাধিক শিশু পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয় এবং দশটি শিশু মৃত্যুবরণ করে। 
এছাড়াও এই তো সেদিন ২০০৯ সালে হিনি (Hini) নামের একটি ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা প্রয়োগের ফলে বেশ কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, তারা পরবর্তীতে নারকোলেপসিতে আক্রান্ত হয়েছে। নারকোলেপসি অর্থ হচ্ছে সময়-অসময়ে নিদ্রাভাব কিংবা ঝিমুনি।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, টিকা শুধু ত্রুটিমুক্ত হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, এর সুষ্ঠু সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণও পর্যাপ্ত গুরুত্ব বহন করে। তা না হলে যে কোনও সময় যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। হাফকিনের কথা আমি পূর্বেই বলেছি, যিনি কলেরা ও প্লেগের দু-দুটি টিকা আবিষ্কার করেছিলেন। তো হয়েছে কি সেই হাফকিন মহাশয়ের টিকা নেয়ার পর ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের মালকোয়াল গ্রামে ১৯০২ সালের মার্চ মাসে ১৯ জন মানুষ ধনুষ্টংকারে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। যেসব সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় তা থেকে জানা যায় যে, পারেল গবেষণাগারে ৪১ দিন আগে তৈরি একটি বিশেষ বোতলের ভ্যাকসিন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এ বিষয়ে ভারত সরকার একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে। তারা দেখতে পায় যে, বোতল শুদ্ধি করার জন্য কার্বলিক অ্যাসিড ব্যবহার না করে তাপ প্রয়োগের মাধ্যমে তা বিশুদ্ধ করা হয়েছিল। আর এটা করা হয়েছিল মি. হাফকিনের নির্দেশে। কারণ, এইভাবে বেশি সংখ্যক বোতল দ্রুততম সময়ে বিশুদ্ধ করা যেত। এই তাপমাত্রা প্রয়োগের পদ্ধতি তার দু-বছর আগে অর্থাৎ ১৯০০ সাল থেকেই বিশ্বখ্যাত লুই পাস্তুর ইনস্টিটিউটে ব্যবহার হয়ে আসছিল। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের তা অজানা ছিল। তদন্তের পর মি. হাফকিনকে প্লেগ গবেষণাগারের প্রধানের পদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং ভারতীয় সিভিল সার্ভিস থেকে তাঁকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হয়। পরবর্তীকালে প্রতিবেদনের দলিল-দস্তাবেজ ঘাঁটাঘাঁটি করে লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক ডব্লিউ. জে. সিম্পসন ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে লেখা এক চিঠিতে যুক্তি তুলে ধরেন যে, ভ্যাকসিনের বোতলটি পারেল গবেষণাগারে নষ্ট হয়নি। সেটি নষ্ট হয়েছিল পাঞ্জাবের সেই গ্রামে যেখানে টিকা কর্মসূচি চলছিল।
টিকা গ্রহণকারী জনসাধারণের মধ্যে আরো কয়েকটি বিষয়ে বেশ ধন্দ রয়েছে। কারণ কোনও টিকা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানই স্পষ্ট করে বলছে না তাদের এই টিকাগুলো আসলে কতটা সময় কার্যকর থাকবে। ছ-মাস, এক বছর, দু-বছর। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান বলছে, কমপক্ষে এই টিকা ছ-মাসের জন্য কার্যকরী হবে আর এজন্যই বোধহয় আমার এক বন্ধু পরিহাস করে আমাকে একদিন বললেন - তাহলে কি আমরা এখন টিকা পকেটে নিয়ে ঘুরবো। 

এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত চারটি টিকা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার বায়োএনটেক, মর্ডানা এবং সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি নোভাভ্যাক্সের টিকা। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই জোর গলায় বলছে না যে এটা শতভাগ কার্যকরী। কেউ বলছে ৯০% কার্যকর, আবার কেউ বলছে ৯৫% কার্যকরী। এই বিষয়গুলোও মানুষের মধ্যে টিকা না নেয়ার কারণ হিসেবে কাজ করছে। দেশের জনসাধারণ এটাও জানে যে, এত হইচই, ঢাকঢোল পিটিয়ে টিকা দেয়ার আয়োজন করলেও এর পেছনে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ওঁৎপেতে আছে কীভাবে এই টিকাকে পুঁজি করে নিজের ধনসম্পদ আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করা যায়। যেমন ধরুন, পূর্বে যে বিজ্ঞানী টিকা আবিষ্কার করতেন, টিকাটি সাধারণত তাঁর নামে হতো, যেমন সাল্ক ভ্যাকসিন, জেনার ভ্যাকসিন ইত্যাদি; কিন্তু বর্তমান সময়ের টিকাগুলোর নাম সব বহুজাতিক কোম্পানির নামে।

বিশ শতকের মাঝামাঝি জোনাস সাল্ক আবিষ্কার করে ফেললেন পোলিওর টিকা। মানবসভ্যতায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের সে এক যুগান্তকারী অবদান। সাল্ককে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, টিকাটির প্যাটেন্ট কার? উত্তরে সাল্ক বলেছিলেন - জনগণের। অর্থাৎ, কোনও প্যাটেন্ট নেই। সূর্যের কী প্যাটেন্ট নেওয়া সম্ভব? ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০১২ সালের এক নিবন্ধে হিসাব কষে দেখানো হয়েছে, পোলিও টিকার প্যাটেন্ট না নিয়ে সাল্ক হারিয়েছেন প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার!

টিকা আতঙ্কের আরেকটি প্রধান কারণ ‘সুঁচভীতি’ যেটাকে ইংরেজিতে নিডেল ফোবিয়া বলে (Needle Fobia)। আমি বেশ ভালো করে লক্ষ করে দেখেছি, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই এই সুঁচ-আতঙ্ক প্রকটভাবে কাজ করে। গ্রামাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে এ ধরনের ভয় আরো অধিক। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের একজন বিশিষ্ট লেখক সচ্চিদানন্দ দত্ত রায়ের লেখা ‘পুরানো বালাম চালের ভাত’ গ্রন্থটিতে আমি পড়েছিলাম বেশ কিছু বছর আগে। লেখকের আদিবাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলায়। তিনি লিখেছেন - মনে আছে, একবার এত বেশি ইলিশ মাছ উঠতে লাগল যে ইলিশ মাছই লোকজনের প্রধান খাদ্য হয়ে উঠল। ফলে, পেট ছেড়ে দিল। কলেরায় মানুষের অবস্থা করুণ। খবর পেয়ে থানা (হিজলা) থেকে ইন্সপেক্টর সাহেব সাইকেলে পাইক পেয়াদা নিয়ে বাজারে ঢোলসহরত দিয়ে ইলিশ মাছ বিক্রি কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করে দিলেন আর বাজারের সব মাছ মাটিতে পুঁতে দিলেন। কলেরার ইঞ্জেকশন দিতে আরম্ভ হতেই লোকজনের ইলিশ কেনায় ভাটা পড়ল। কেউ টুঁ-শব্দটি করলেন না, সবাই মেনে নিলেন। সুঁচের ফোঁড়, না ইলিশ? ফোঁড়ের ভয়ই জয়ী হলো।

হাস্যকর হলেও সত্য যে, পশ্চিমা দেশগুলোতেও এই সুঁচভীতি মানুষের সংখ্যা অনেক। একটি জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার দশ শতাংশ মানুষ সুঁচভীতিতে ভোগেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো, এই সংখ্যা নাকি আরও অধিক। আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা জাকি চ্যানকে চেনেন। তো হয়েছে কি, একবার অভিনয়ের অংশ হিসেবে স্ট্যান্ট করতে গিয়ে তার একটি আঙুল ভেঙে যায়। ভাঙা আঙুল ঠিক করতে হাত অবশ করা প্রয়োজন আর সেজন্য ডাক্তার যেই না জাকি চ্যানের শরীরে ইনজেকশন পুশ করতে উদ্যত হয়েছেন অমনি জাকি চ্যান ভয়ে কুঁকড়ে বললেন - দাঁড়ান ইনজেকশন দিতে হবে না। আমি নিজেই ভেঙে উলটে যাওয়া আঙুল স্বস্থানে ফিরিয়ে আনছি। এই বলে ভেঙে যাওয়া আঙুলটি মুঠো করে ধরে সজোরে ঘুরিয়ে স্বস্থানে ফিরিয়ে আনলেন। উলটে যাওয়া আঙুল স্বস্থানে ফিরিয়ে আনাতে তাঁর কী পরিমাণ ব্যথা হওয়ার কথা একটু ভেবে দেখুন তো। কিন্তু তারপরও সুইয়ের অল্প একটু ব্যথা সহ্য করার মতো ক্ষমতাও তাঁর নেই। 

তবে এর উলটোচিত্রও আছে। সাঁওতাল কিংবা যে কোনও আধিবাসীর ইনজেকশন নেয়ার সময় ব্যথা না পেলে নাকি তারা মনে করে সে ওষুধের কোনও কার্যক্ষমতা নেই। ১৯৭৩ সালে আমার শ্বশুর সদ্য ডাক্তারি পাস করে সিলেটের জাফলং অঞ্চলে বদলি হয়েছেন। সেখানে অনেক সাঁওতাল ও উপজাতির বসবাস। আমার শ্বশুরের এমন হাতযশ যে তিনি ইনজেকশন পুশ করলে কেউ ব্যথা পায় না। একদিন এক সাঁওতাল মহিলা আমার শ্বশুরকে বলল, আপনার ওষুধের মনে হয় কোনও কার্যক্ষমতা নেই। আমার শ্বশুর অবাক হয়ে বললেন, আপনার কেন মনে হলো যে আমার ইনজেকশনে কার্যক্ষমতা নেই? তখন সেই সাঁওতাল মহিলাটি বললেন, আপনি যখন ইনজেকশন দেন একটু ব্যথাও পাই না। অথচ আপনার অমুক ডাক্তার বন্ধু যখন ইনজেকশন দেয় প্রচণ্ড ব্যথা পাই আর তাতেই মনে হয় যেন উনার ইনজেকশন বেশি কার্যকরী। সাঁওতাল ওই মহিলার কথা শুনে আমার শ্বশুর মশাই তো বেশ অবাক! বলে কী মেয়েটি! একদিন কাছে পেয়ে আমার শ্বশুর যখন তাঁর সেই সতীর্থ ডাক্তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, কিরে ইনজেকশন দিতে গিয়ে রোগী ব্যাথা পায় কী করে? আমার শ্বশুরের সেই বন্ধুটি তখন বললেন, কী করব হুমায়ুন, ইনজেকশন দিতে গিয়ে ব্যথা না পেলে ওরা মনে করে যে এই ওষুধের কোনও কার্যকারিতা নেই। সেজন্য ইনজেকশন দেয়ার পূর্বে সুচের ডগাটি মেঝেতে ঘষে খানিকটা অমসৃণ করে নিই। একথা শুনে আমার শ্বশুর তো বিস্ময়ে একেবারে থ।

আমার ধারণা বাঙালিদের চেয়ে সাঁওতাল, খাসিয়া, মগ, মুরং প্রভৃতি উপজাতি বেশি সচেতন কারণ যে বছর মি. হাফকিন কলকাতার বস্তিতে তাঁর টিকার সফল পরীক্ষা চালিয়েছিলেন, তার পরের বছর আসামের চা-বাগানের মালিকরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানান সেখানে গিয়ে বাগানের শ্রমিকদের ওপর তাঁর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে। তিনি সেখানে হাজার হাজার শ্রমিককে টিকা দেন। 

টিকাদানে উৎসাহিত করার জন্য দেশের বড় বড় সব হোমরা-চোমরার টিকা দেয়ার ছবি টেলিভিশন ও সোশ্যাল যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বেশ ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। এটি বেশ ভালো টেকনিক। সেকালে মি. হাফকিনও একই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ শ্বেতাঙ্গ ডাক্তারদের বাদ দিয়ে কলকাতার সব বড় বড় স্থানীয় লোকজন, যেমন - ডা. চৌধুরী, ডা. ঘোষ, ডা. চ্যাটার্জি এবং ডা. দত্তদের মতো ভারতীয়দের সঙ্গে নিয়ে কাজ করতেন। তিনি আরও একটা কৌশল অবলম্বন করলেন, সেটা হলো, তাঁর উদ্ভাবিত টিকা জনসমক্ষে তিনি নিজের দেহে প্রয়োগ করতেন। উদ্দেশ্য এটা দেখানো যে, এটা নিরাপদ।

আমাদের বর্তমান করোনা প্রতিরোধ টিকা প্রদান কর্মসূচি সফল করতে হলে সরকারকে আরও সচেতন হতে হবে। টিকা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ও বিস্তারিত তথ্য জনগণকে জানাতে হবে। সেই সঙ্গে হতে হবে আরও বেশি আন্তরিক। সেই হাফকিনের কথাই ঘুরেফিরে আসে - ভারতীয় ডাক্তারদের সঙ্গে নিয়ে তিনি দিনরাত বস্তিতে বস্তিতে ঘুরতেন। বস্তির মজদুররা কাজে বেরুনোর আগে তিনি তাদের টিকা দিতেন। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময়েও লোকজন দেখতে পেত যে মি. হাফকিন তেলের বাতি জ্বালিয়ে বস্তিতে একমনে কাজ করে যাচ্ছেন।

লেখক : গল্পকার, কলামনিস্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

সাইফুর রহমান