ঢাকা Monday, 06 May 2024

নারীলোভী শিল্পপতি টিএ ফারুকের বিরুদ্ধে স্ত্রীকে গুণ্ডা দিয়ে পেটানোর অভিযোগ

মোংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: 18:11, 24 April 2024

নারীলোভী শিল্পপতি টিএ ফারুকের বিরুদ্ধে স্ত্রীকে গুণ্ডা দিয়ে পেটানোর অভিযোগ

টিএ ফারুক

তালুকদার আখতার ফারুক ওরফে টিএ ফারুক। বয়স সত্তরের কাছাকাছি। মোংলা বন্দর শহরের বহুল আলোচিত একজন শিল্পপতি। বহু বিবাহের নায়ক এই শিল্পপতির বিরুদ্ধে নারী কেলেংকারির নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কখনো নিজে বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন, আবার কখনো অধীনস্থ কর্মচারীদের বিয়ে করিয়ে নারীদের রক্ষিতা বানিয়ে রাখছেন তিনি। 

এসব নিয়ে এবার ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে নিজ স্ত্রীকে পেটানোর অভিযোগ উঠেছে টিএ ফারুকের বিরুদ্ধে। 

জানা গেছে, টিএ ফারুকের লালসার শিকার হয়েছেন সুমি বেগম (২৫) নামে দুই সন্তানের জননী। উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের কানাইনগর গ্রামের এই নারীর সঙ্গে বছর দুয়েক আগে ফারুকের পরিচয়। এরপর নানা প্রলোভন দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত ওই নারীর সংসার ভেঙে তিনি তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর ফারুক শহরের শ্রম কল্যাণ রোডে তার জলসাখানা শতরুপা বরফকলের দ্বিতীয় তলার ভবনে ওঠেন স্ত্রী সুমিকে নিয়ে। 

এখানে বছর দেড়েক ভালোই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু সুমির চোখে ধরা পড়ে স্বামী টিএ ফারুকের বহুগামিতা। এ নিয়ে শুরু হয় পারিবারিক দ্বন্দ্ব। এক পর্যায় স্ত্রী সুমিকে তাড়াতে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকেন ফারুক। এমনকি গত শনিবার (২০ এপ্রিল) দুপুরে তীব্র তাপদাহের মধ্যে সুমিকে রুম থেকে বের করে তালা ঝুলিয়ে দেন তিনি। পরে বিষয়টি স্থানীয় পৌর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যস্থতায় সুরাহা হয়। 

সর্বশেষ গত সোমবার (২২ এপ্রিল) রাত ১০টায় ২৫-৩০ জন ভাড়াটে গুণ্ডা সুমির ঘরে হানা দিয়ে তাকে মারধরসহ সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়ার চেষ্টা করে। এ নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী হুলস্থূল কাণ্ড ঘটে শতরুপা বরফকলে। 

পরে রাতেই প্রতিবেশীরা সুমিকে উদ্ধার করে মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। স্বামী টিএ ফারুকের ভাড়াটে গুণ্ডাদের মারধরে আহত সুমি এখন ডাক্তারের চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টিএ ফারুক (তালুকদার আখতার ফারুক) স্বাধীনতার পর বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার মল্লিকের বেড় ইউনিয়ন থেকে মোংলায় এসে প্রথমে চাল-গমের ছোটখাট ডিলার ব্যবসা শুরু করেন। পরে এরশাদের শাসনামলে তার ভাগ্য খুলে যায়। তিনি জাতীয় পার্টির উপজেলা সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন বিগত কয়েক দশক। এ সময় তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থবিত্ত ও জমির মালিক বনে যান। একচেটিয়াভাবে খাদ্য পরিবহন, ঠিকাদারি, বার্জ  (নৌযান) ব্যবসা করতে থাকেন। 

অভিযোগ রয়েছে, খাদ্য বিভাগের পরিবহন ঠিকাদারি ব্যবসার অন্তরালে তিনি কালোবাজারি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যান। এসব ব্যবসার পাশাপাশি তিনি বরফকল ও আবাসিক হোটেলসহ নানা ব্যবসা করতে থাকেন। 

জাতীয় পার্টি ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েক বছর পরে কয়েক দফায় তিনি রাজনৈতিক খোলসও বদল করেন। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মঞ্চে তাকে মাঝে মধ্যে দেখা যায়। 

তার প্রথম স্ত্রী সরবরিয়া খানম দরিয়া এবারে অনুষ্ঠিতব্য মোংলা উপজেলা নির্বাচনে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে প্রার্থী হবেন বলে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অবশ্য ফারুকও এর আগে উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান ও পৌরসভার চেয়ারম্যান (মেয়র) হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। 

বর্তমানে টিএ ফারুক একজন শিল্পপতি। কিন্তু তার নেশা মোবাইল ফোন ও দালালদের মাধ্যমে নারীদের সঙ্গে সুকৌশলে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং নিজের অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা। এভাবে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান ধর্মের অসংখ্য নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলে টক অফ দ্য টাউনে পরিণত হয়েছেন টিএ ফারুক। 

জানা গেছে, নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক করতে দিন-রাত তার মোংলা পৌর শহরের শ্রম কল্যাণ রোডের জলসাখানায় চলে বেহায়াপনা। এ নিয়ে অতিষ্ঠ ওই এলাকার লোকজন।

সূত্র জানায়, নারীদের সঙ্গে প্রেম অতঃপর ভোগবিলাসের এই কাজে তাকে সহযোগিতা করে ১৫/২০ জনের একটি সিন্ডিকেট। মোংলাসহ আশপাশের উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে অসহায় গরিব পরিবারের সুন্দরী মেয়েদের বাড়ি-জমিসহ মোটা অংকের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে দালালরা নিয়ে আসে ফারুকের জলসাখানায়। সেখানে চলে উদ্যম গান-বাজনা ও রাতভর বেহায়াপনা। এ বিষয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তার ভাড়াটে মাস্তান বাহিনী দিয়ে দমন করা হয়। এদিকে প্রশাসনও এই ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীরব। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফারুকে সাবেক কয়েকজন কর্মচারী জানান, টিএ ফারুক ব্যবসা ও রাজনীতির অন্তরালে একজন কুখ্যাত নারীলোভী। যে নারীকে একবার তার মনে ধরে তাকে ছলে-বলে-কৌশলে তিনি বিয়ে করেন এবং লালসা মিটলে তালাক দিয়ে দেন। এ সংক্রান্ত বহু ঘটনা মোংলার গণ্যমান্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিরা সালিশ করে সুরাহা করেছেন।

শতরুপা বরফকল ও হোটেল সিঙ্গাপুর এবং চৌরাঙ্গীসহ একাধিক স্থানে তার এমন ঘাঁটি রয়েছে। তার বহুগামিতা নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনা থাকলেও তিনি ঠিক কতগুলো বিয়ে করেছেন তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি।

ফারুকের সর্বশেষ স্ত্রী সুমি আক্তার জানান, এ পর্যন্ত তার অন্তত অর্ধশতাধিক বিবাহের খোঁজ পেয়েছেন তিনি। তবে বর্তমানে তার কতজন স্ত্রী রয়েছেন তা তিনি জানেন না। আরো শতাধিক নারীর সঙ্গে তার পরকীয়া সম্পর্ক রয়েছে। 

তিনি আরো বলেন, এখনো কোনো নারী তার চোখে একবার পছন্দ হলে তিনি যে করেই হোক তাকে নানা প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ে করে পরে তালাক দিয়ে ছেড়ে দেন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে টিএ ফারুকের হোটেলের ম্যানেজার সোহাগ বলেন, তার বস (মালিক) যখন যা নির্দেশ করেন তখন তাই করতে হয়। এক্ষেত্রে তার কোনো দোষ নেই। 
সোহাগ আরো জানান, টিএ ফারুকের সর্বশেষ স্ত্রী সুমি আক্তারকে তিনি ম্যানেজ করেছিলেন।  

এ প্রসঙ্গে মোংলা পোর্ট পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরিফুল ইসলাম জানান, টিএ ফারুকের সর্বশেষ স্ত্রী সুমিকে নিয়ে পারিবারিক সমস্যার বিষয়টি নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। 

টিএ ফারুকের প্রতিবেশী মোংলা উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এইচএম দুলাল বলেন, টিএ ফারুকের বরফকল উঠতি বয়সী নারীদের আড্ডাস্থল হয়ে উঠছে। এতে এলাকার সামাজিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। এ বিষয় প্রশাসনের নজরদারিসহ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। 

এসব বিষয়ে মোংলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নিশাত তামান্না বলেন, নারীদের প্রতি তার এমন অসম্মান সামাজিকভাবে নৈতিক অবক্ষয় ও দুঃখজনক। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

টিএ ফারুকের বিরুদ্ধে স্ত্রী সুমির করা অভিযোগ পেয়েছেন স্বীকার করে মোংলা থানার ওসি কেএম আজিজুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। 

এসকল বিষয়ে টিএ ফারুককে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এছাড়া মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) দুপুরে তার সিঙ্গাপুর হোটেলে গিয়ে সাংবাদিক পরিচয় দিলে ‘পরে কথা বলবেন’ বলে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়।