জয়পুরহাটের কালাইয়ে গবাদিপশু দেয়ার নামে প্রায় পাঁচ হাজার গ্রাহকের জমানো এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়েছন সওজ (স্মার্ট অর্গানাইজেশন অফ জয়পুরহাট) নামে এক এনজিওর পরিচালক জয়নুল হোসেন। অফিস বন্ধ করে রাতের আঁধারে আসবাবপত্র নিয়ে পালিয়েছেন তিনি।
এদিকে জমানো টাকা না পাওয়ার আশংকায় ভুগছেন গ্রাহকরা। কয়েকদিন ধরে অফিস বন্ধ দেখে নিরুপায় হয়ে ফিরে যাচ্ছেন গ্রাহকরা। বাধ্য হয়ে আফছার আলী নামে এক গ্রাহক বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন।
জানা গেছে, ২০২৩ সালে কালাই উপজেলা সমাজসেবা অফিস থেকে গবাদিপশু পালনের সি-১৪০৭৩১ নম্বর রেজিস্ট্রেশন নিয়ে উপজেলার মাত্রাই বাজারে সওজ নামে একটি এনজিও কার্যক্রম শুরু করে। প্রতিটি গ্রামে ১৫ থেকে ২০ সদস্যের দুই থেকে তিনটি করে সমিতি গঠন করেন এনজিওটি। প্রত্যেকের কাছ থেকে ভর্তি ফি বাবদ ১০০ টাকা এবং সাপ্তাহিক সঞ্চয় ৫০ টাকা করে জমা নেয়া হয়।
সে সময় সওজের পরিচালক জানান, গ্রাহকদের জমানো অর্থের বিনিময়ে গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি দেয়া হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজনকে দেয়াও হয়েছে।
বিগত নয় মাসে এই এনজিওর গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। তারা এই প্রতারকচক্রের কথায় বিশ্বাস করে লাভের আশায় এখানে টাকা রাখেন।
এরই এক পর্যায়ে মাত্রাইসহ আশপাশের শতাধিক গ্রামের পাঁচ হাজার গ্রাহকের জমানো প্রায় এক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন সওজ-এর পরিচালক জয়নুল হোসেন।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করতেন তাদেরও ঠকিয়েছেন এই ব্যক্তি। তিনি ২০ জন কর্মীর কাছ থেকে জামানত বাবদ ৩ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু পরিচালক পালানোতে এখন সমিতির সদস্যরা ধরনা দিচ্ছেন এই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাড়িতে।
থানায় লিখিত অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, গত ৯ মাস আগে উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের আরবাব গ্রামে ১৬ সদস্যের একটি সমিতি গঠন করেন এনজিওটির কর্মীরা। সেদিন নির্বাহী পরিচালক ও কালাই উপজেলার শকুনা গ্রামের বাসিন্দা জয়নুল হোসেন এ সমিতিতে উপস্থিত ছিলেন। সে সময় এনজিওর ব্যবস্থাপক মাত্রাই ইউনিয়নের বিয়ালা গ্রামের বাসিন্দা মফিদুল ইসলাম এবং মাঠকর্মী মাত্রাই গ্রামের বাসিন্দা সুমাইয়া আক্তারও উপস্থিত ছিল।
১৬ জনের ভর্তি ফিসহ সঞ্চয় জমা হয়েছে ৩২ হাজার ৮০০ টাকা। গত সপ্তাহে তাদের সমিতির দুজন সদস্যকে ছাগল দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু তারা এসে অফিসের গেটে তালা ঝুলছে দেখে হইচই করেন। এরপর সমিতির পক্ষে গ্রাহক আফছার আলী বাদী হয়ে থানায় তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।
আফছার আলী বলেন, একদিন কাজ না করলে না খেয়ে থাকতে হবে সবাইকে। খেয়ে না-খেয়ে সঞ্চয় করেছি। তারা প্রায় ৩৩ হাজার টাকা নিয়ে উধাও। অফিসে গিয়ে দেখি তালা ঝুলছে। থানায় গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছি।
মাত্রাই গ্রামের সদস্য শামছুন নাহার বলেন, এই গ্রামে তিনটি সমিতি আছে। যার বেশি সঞ্চয় হবে সে একটি গরু পাবে। এজন্য সবাই বেশি করে সঞ্চয় দিয়েছি। এ সমিতি থেকে ৫০ হাজারেরও বেশি টাকা সঞ্চয় জমা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কেউ কিছুই পাইনি।
এনজিওকর্মী সুমাইয়া আকতার বলেন, আমি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। এইচএসসি পাস করে বাড়িতে বসেছিলাম। পরিচালক জয়নুল পরিচিত বলে ১০ হাজার টাকা জামানাত দিয়ে সেখানে কাজ করছিলাম। এখন সবাই পলাতক। গ্রাহকরা আমার বাড়িতে ভিড় করছেন।
গ্রাহকের সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, পাঁচ হাজারের কম নয়, বরং বেশিই হবে।
সওজ এনজিওর ব্যবস্থাপক মফিদুল ইসলাম জানান, ৫০ হাজার টাকা জামানত দিয়ে তিনি মাত্রাই শাখায় ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। গত বৃহস্পতিবার বেশ কয়েকটি সমিতির সদস্যদের গরু, ছাগল ও হাঁস-মুরগি দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু বুধবার রাতে সবকিছু নিয়ে অফিসের মূল গেটে তালা ঝুলিয়ে পরিচালক গা ঢাকা দিয়েছেন।
মাত্রাই মডেল কলেজের অধ্যক্ষ মনোয়ার হোসেন বলেন, পরিচালক জয়নুল হোসেন একজন প্রতারক। সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তার কঠিন শাস্তি হওয়া দরকার।
এদিকে সওজ এনজিওর পরিচালক জয়নুল হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, এমনিতেই বিপদে পড়ে এলাকা ছেড়েছি, নিউজ করলে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এসময় নিউজ না করার অনুরোধ জানান তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহা. আতাউর রহমান বলেন, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজের জন্য তাদের অনুমতি দেয়া হয়েছে; কিন্তু সঞ্চয় বা ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নয়। তাদের ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খোঁজ নিতে বলেছেন। তদন্ত চলছে।
কালাই থানার ওসি ওয়াসিম আল বারি বলেন, পরিচালকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জান্নাত আরা তিথি বলেন, সমিতির সদস্যরা অভিযোগ করেছে। ব্যবস্থা নিতে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে।
