
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আরমান নামে এক যুবকের ওপর হামলা চালিয়ে তার কব্জি বিচ্ছিন্ন করার ভিডিও বানিয়ে টিকটকে ছেড়ে দিয়েছিল সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনার পর অভিযুক্ত সাত যুবককে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
গতকাল শুক্রবার (৮ সেপ্টেম্বর) থেকে শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) ভোর পর্যন্ত এই চক্রকে ধরতে অভিযান চালায় র্যাব। পরে মোহাম্মদপুর ও বাগেরহাট এলাকা থেকে চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন - আহমেদ খান (২২), মো. হাসান ওরফে গুটি হাসান (২৪), মো. হানিফ হোসেন জয় (২৪), রমজান (২৩) ও মো. রাজু (১৯)। তাদের কাছ থেকে ডাকাতি ও হামলার কাজে ব্যবহৃত দেশীয় ধারালো অস্ত্র পাওয়া গেছে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মো. রাফিদুল ইসলাম রানা ওরফে রাফাত (২৩) ও তুষার হাওলাদারকে (২৩) গ্রেপ্তার করা হয়।
এ নিয়ে শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে কথা বলেন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাচ্ছিল। এদের বিরুদ্ধে হামলা ও ছিনতাইয়ের অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ও মামলা হয়েছে। বিভিন্ন গ্রুপের সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে এক গ্রুপ অপর গ্রুপের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে মারামারি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যায়।
সম্প্রতি কতিপয় সন্ত্রাসী মোহাম্মদপুরে আরমান নামে এক যুবকের হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করে। এ দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করে। এ ঘটনায় গত ২৭ আগস্ট ভুক্তভোগী বাদী হয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যাচেষ্টার মামলা করেন।
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কমান্ডার মঈন জানান, আসামিরা মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য। তাদের গ্রুপে প্রায় ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। রাফাত, তুষার ও আনোয়ার কয়েক বছর ধরে গ্রুপটির নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা মোহাম্মদপুর, আদাবর, বেড়িবাঁধ ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করত। এই গ্রুপের সন্ত্রাসীরা একাকী পথচারীদের আকস্মিকভাবে ঘিরে ধরে চাপাতিসহ ধারালো অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই করে দ্রুত পালিয়ে যায়। তারা বিভিন্ন সময় চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ঢাকা উদ্যান, আদাবর, শ্যামলী, মোহাম্মদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারামারিসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমও পরিচালনা করতো।
ওই এলাকাগুলোয় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের জন্য ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবেও কাজ করতো এরা। এছাড়া মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিল। গ্রুপের সদস্যরা রাস্তাঘাটে ইভটিজিং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপ্রীতিকর ভিডিও শেয়ারসহ বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ কার্যক্রমেও জড়িত।
জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা আরমানের কব্জি বিচ্ছিন্নের ঘটনায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে। পূর্বশত্রুতার জের ধরে আসামি তুষার ভুক্তভোগী আরমানের বাঁ হাতে চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়ে কব্জি বিচ্ছিন্ন করে। রাফাত ধারালো চাপাতি দিয়ে কোপ দিয়ে ভুক্তভোগী আরমানের ডান হাত প্রায় বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এর আগেও তারা বিভিন্ন মানুষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন করেছে। এসব ঘটনার চিত্র ধারণ করে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিত।
রাফাত কোনো মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করত না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আইডি খুলে ওয়াইফাইয়ের মাধ্যমে সে ভুক্তভোগীদের হুমকি দিত।
আসামিদের বিষয়ে খন্দকার আল মঈন বলেন, মো. রাফিদুল ইসলাম রানা ওরফে রাফাতের নেতৃত্বে মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় বিগত ৪-৫ বছর ধরে একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ পরিচালিত হয়ে আসছিল। সে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিত, গ্রুপটির প্রধান হিটম্যানও সে। গ্রুপের অন্য সদস্যদের মাধ্যমে সে মোহাম্মদপুর, আদাবর ও বেড়িবাঁধ এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম করত।
কব্জি কাটার ঘটনার পর গ্রেপ্তার এড়াতে রাফাত প্রথমে ফরিদপুরের একটি মাজারে গিয়ে আত্মগোপন করে। সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর আত্মগোপনের উদ্দেশ্যে বাগেরহাটে যায়। সেখান থেকে অন্যত্র আত্মগোপনে যাওয়ার সময় র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয় রাফাত। তার বিরুদ্ধে মারামারি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজির অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার তুষার হাওলাদার একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের অন্যতম সদস্য। রাফাতের নির্দেশনা অনুযায়ী ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পরিকল্পনা করত সে। পরবর্তীতে গ্রুপের অন্য সদস্যরা তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত। কব্জি কাটার ঘটনার পর সে রাফাতের সঙ্গে আত্মগোপন করে ও বাগেরহাট থেকে গ্রেপ্তার হয়। তার বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
গ্রেপ্তার আহমেদ খান ওই সন্ত্রাসী গ্রুপের অন্যতম সদস্য। সে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত টার্গেট নির্বাচন করত। কব্জি বিচ্ছিন্নের ঘটনার সময় রাফাত ও তুষারের সঙ্গে সে-ও ছিল। সে-ই আরমানের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনার পর সে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে কিছুদিন আত্মগোপনে থাকে। গতকাল শুক্রবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় চার সহযোগীসহ ডাকাতির পরিকল্পনার সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে।
মো. হাসান ওরফে গুটি হাসান, হানিফ হোসেন জয়, রমজান ও রাজু এই সন্ত্রাসী গ্রুপের সদস্য। তারা গ্রেপ্তার রাফাতের নেতৃত্বে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করত। টার্গেট নির্বাচনের পর পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ভুক্তভোগীকে নৃশংসভাবে হামলা করে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রী লুট করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করত। রাজধানীর আদাবরসহ বিভিন্ন থানায় তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলেও তিনি কমান্ডার মঈন।
নির্বাচনকে সামনে রেখে মোহাম্মদপুর, আদাবর ও মিরপুর এলাকায় কিশোর গ্যাং ও সন্ত্রাসী বাহিনীরা সরব হচ্ছে। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী ব্যবস্থা নেবে - জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১৭ সালের র্যাব প্রথম কিশোর গ্যাং কালচার আবিষ্কার করে। আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি। পদক্ষেপ নেয়ার পরও তারা এসব কার্যক্রম থেকে অনেকে সরে আসছে না। কিশোর গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত ১ হাজার ১০০ সদস্যকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। সারা বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং দমনে ও এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে যেসব আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন তা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।