ঢাকা Friday, 29 March 2024

টাঙ্গাইলে মহামারির কারণে বাল্যবিয়ের শিকার ১৪২ শিক্ষার্থী

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি

প্রকাশিত: 23:44, 21 September 2021

আপডেট: 00:15, 22 September 2021

টাঙ্গাইলে মহামারির কারণে বাল্যবিয়ের শিকার ১৪২ শিক্ষার্থী

প্রতীকী ছবি

করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ দেড় বছর বন্ধ ছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ সময় উপার্জনক্ষম অনেকেই হয়ে পড়েছিলেন বেকার। ফলে পরিবারের অর্থাভাব, দারিদ্র্যের শিকার হয়ে, অভিভাবকদের চাপে, টাঙ্গাইলে এক ছাত্রসহ ১৪২ শিক্ষার্থীকে বসতে হয়েছে বাল্যবিয়ের পিঁড়িতে। ছাড়তে হয়েছে লেখাপড়া।  

শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে, এ উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়নে ১৭০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫৫টি মাধ্যমিক, আটটি কলেজ, ১৪টি মাদ্রাসা এবং তিনটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪০ হাজার, উচ্চ মাধ্যমিকে ৩৯ হাজার ১৯২, কলেজে ৮ হাজার ৭৫২ ও মাদ্রাসায় ৩ হাজার ৭৭৫ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। 

জানা গেছে, বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা বাল্যবিয়ের খবর পেয়ে বিয়েবাড়িতে উপস্থিত হয়ে কয়েকটি বিয়ে বন্ধ করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে ওইসব পরিবারের অভিভাবকরা বিভিন্ন উপায়ে বয়স বাড়িয়ে মেয়েদের বিয়ে দেন বলে অভিযোগ শিক্ষকদের।

মির্জাপুর সরকারি সদয় কৃষ্ণ মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী এক হাজার ৯৬২ জন। এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণীর এক ছাত্রী প্রেম করে সম্প্রতি বিয়ে করেছে। এছাড়া ২০২১ সালের ২৮৮ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে একজন ও ২০২২ সালের এসএসসির ৩৪৪ জনের মধ্যে পাঁচ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। এ বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার ৬৫ থেকে ৭৫ ভাগ। 

সদরের মির্জাপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ হতে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এক হাজার ৪৬০ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। উপস্থিতির হার ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনালসহ নবম শ্রেণীতে ২৯১ ছাত্রী রয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জনের বিয়ে হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালের ৩০৬ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৪ জন এবং ২০২২ সালের ২৯৩ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২০ জন বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। সদরের এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বিয়ে হওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিদ্যালয়ে ক্লাস করছে বলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা নিশ্চিত করেছেন। 

দেওহাটা এ জে উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত এক হাজার ১১৯ জন শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। অষ্টম শ্রেণীর একজন, নবম শ্রেণীর চারজন, এসএসসি (২০২১) ১৯৮ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে আটজন ছাত্রী এবং এসএসসি (২০২২) ২০৬ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে একজন ছেলে ও ১২ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের পিঁড়িতে বসেছে বলে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. খোরশেদ আলম জানিয়েছেন। এ বিদ্যালয়ে ছাত্রীর উপস্থিতি বেশি। উপস্থিতির হার ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ।

উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত গেড়ামাড়া গোহাইলবাড়ি সবুজ সেনা উচ্চ বিদ্যালয়। গত দেড় বছরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ শ্রেণীর চারজন, সপ্তম শ্রেণীর নয়জন, ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ১৯ জন ও ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী নয়জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফিরোজ আল মামুন নিশ্চিত করেছেন। বিদ্যালয়টির আশপাশের গ্রামগুলো নিচু এলাকা হওয়ায় বন্যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে আসতে পারছে না। এ বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার ৬৫ থেকে ৭০ ভাগ। 

এদিকে মির্জাপুর উপজেলা সদরের আফাজ উদ্দিন দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসায় গত দেড় বছরে অষ্টম শ্রেণীর একজন ও নবম শ্রেণীর চারজন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।

এই অবস্থা উপজেলার ৬৬ নম্বর বহুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। এ বিদ্যালয়টিতে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান চলে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত দেড় বছরে অষ্টম শ্রেণী পাশ তিন শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম।

পোষ্টকামুরী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা শরফুননিছা খানম জানান, বিদ্যালয়টিতে শিশু হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৭৯৪ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। উপস্থিতির হার ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ। 

সদরের আফাজ উদ্দিন দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাসার সুপার মোহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ দারিদ্র্য। করোনা মহামারিতে কর্মজীবী অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েন। এতে দরিদ্র মানুষ বেশি বিপাকে পড়েন। একদিকে তাদের সংসার চালানো অপরদিকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতে বেকায়দায় পড়তে হয়। দরিদ্রতার কারণেও অনেক অভিভাবক মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়েছেন বলে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন বলে জানান তিনি।  

গেড়ামাড়া গোহাইলবাড়ি সবুজ সেনা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, বাল্যবিয়ে আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে বড় বাধা। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের এ বিষয়ে বোঝালেও তারা বুঝতে চেষ্টা করেন না। বিভিন্ন উপায়ে মেয়েদের বয়স বৃদ্ধি করে বিয়ে দেন অভিভাবকরা।

মির্জাপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সুলতান উদ্দিন জানান, দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন যে, আদৌ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে কি না। মেয়েরা বাড়িতে অলস সময় পার করেছে। এ সময় কোনো দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে - এমন চিন্তা করে অনেক অভিভাবক ভালো ছেলে দেখে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। তাদের অনেকেই ক্লাস করছে বলে তিনি জানান।

মির্জাপুর থানা মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা ও নিকাহ রেজিস্ট্রার (ভাতগ্রাম ইউনিয়ন) মো. ফরিদ হোসাইন বলেন, অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের বয়স বৃদ্ধির মাধ্যমে বিয়ের বৈধতা নেই। তিনি একটি বাল্যবিয়েরও নিকাহ রেজিস্ট্রি করেননি বলে জানান। তবে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি সাপেক্ষে নিকাহ রেজিস্ট্রি করানো হয় বলে তিনি জানান।