ঢাকা Saturday, 20 April 2024

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

প্রকাশিত: 18:52, 21 March 2023

গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

চরমে উঠেছে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। আইনের তোয়াক্কা না করে গাইবান্ধা জেনারেল হাসপাতালের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা বেশকিছু ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক ও বেশকিছু ওষুধের দোকানের মালিক দালালের মাধ্যমে পরিচালিত করছে রমরমা এই অবৈধ বাণিজ্য। ফলে প্রতিনিয়ত হয়রানিসহ পরীক্ষা-নিরীক্ষাসহ ওষুধ কিনতে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রাপ্ত মহিলা ও পুরুষ দালালরা কেউ থাকেন ডাক্তারের রুমে, কেউ থাকেন রোগীর খোঁজে ঘোরাফেরার মধ্যে, আবার অন্যজন ব্যস্ত থাকেন রোগীদের নিয়ে নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ওষুধ বিক্রিতে। এই দালাল চক্রের মধ্যে নারীসহ প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন প্রতিনিয়ত হাসপাতালে আসা বিভিন্ন রোগীকে হয়রানি করে। 

হাসপাতালের মুল গেটে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে এক নারী রোগীর। তিনি সদর উপজেলার তুলসীঘাট এলাকার শিবপুর গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। হাসপাতালের বাইরে বের হচ্ছিলেন ওই রোগী। তার সঙ্গে রয়েছেন এক নারী দালাল চক্রের সদস্য। রোগীদের ভাগিয়ে অন্যস্থানে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন এই নারী। পরিচয় জানতে চাইলে সে তার নাম শান্তনা রানী বলে জানান। একইসঙ্গে রোগীকে  আল্ট্রাসনোগ্রাম করার জন্য গাইবান্ধা ডিজিটাল ল্যাবে নিয়ে যাওয়ার কথা জানান তিনি। 

হাসপাতালের আউট ডোরে দেখা মেলে রত্না রানী নামে আরেক দালালের। সাজিদ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চাকরী করেন বলে তিনি জানান। কথা শেষ না হতেই সেখান থেকে তারাহুরো করে সটকে পড়েন রত্না রানী। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায় এ নামে আশ-পাশে কোন ডায়াগনস্টিক সেন্টার নেই। 

হাসপাতালের ভেতরে জরুরি বিভাগে প্রবেশ করতেই রোগীদের ভিড় চোখে পড়ে। সেখানে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন সারওয়ার হোসেন তমাল নামে একজন ডাক্তার। পাশে ব্রিজ রোডস্থ এলাকার মিজান নামে বহিরাগত এক যুবকে ওই ডাক্তারকে স্লিপ সরবরাহ করতে দেখা যায়। হাসপাতালের স্টাফ কিনা জানতে চাইলে তিনি তার বিষয়ে ডা. সারওয়ার হোসেন তমালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে নিউজ করলে দেখে নেয়ার হুমকি দেন। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সুমন মিয়ার শ্যালক এই মিজান। মিজান জরুরি বিভাগে থাকেন রোগী কালেকশনের জন্য। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আসা রোগীকে কোন পরীক্ষা দিলেই তিনি তাকে আল-মদিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান।

এ ব্যাপারে ডা. সারওয়ার হোসেন তমাল বলেন, মিজান একজন স্বেচ্ছাসেবী। সে আমাদেরকে সহযোগিতা করে থাকেন। মিজান কোনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত আছে কিনা আমার জানা নেই। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে বলুন।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা খলিলুর রহমান (৫২) বলেন, হাসপাতালে শুধুমাত্র চিকিৎসাপত্র দেয়া হয়। কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন হলে হাসপাতালে পরীক্ষা না করে বাইরে যেতে বলেন। সেখানে ওই চক্রের সঙ্গে হাসপাতালের লোকজনের যোগসাজশ রয়েছে। এছাড়াও হাসপাতালে কোন ওষুধ দেওয়া হয়না। ফলে চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি হাসপাতালের এক ডাক্তার বলেন, দালাল চক্রের কাছের এক প্রকার জিম্মি হাসাপাতাল কৃর্তপক্ষ।দালাল চক্রের কারণে হাসপাতালে আসা রোগীদের স্বাভাবিক চিকিৎসা প্রদানকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে। মানুষকে তাদের মৌলিক অধিকার সু-চিকিৎসা সঠিকভাবে নিশ্চিত করা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। কিন্তু দেখা যায় হাসপাতালে গাইনি, মেজর ও মাইনর অপারেশন ও প্যাথলজি পরীক্ষা, এক্স-রে, ইসিজি, যক্ষ্মা ও কুষ্ঠসহ প্রায় সব পরীক্ষা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলেও কর্তব্যরত ডাক্তার অসহায় রোগীদের অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে দালালদের হাতে তুলে দেন।

হাসপাতালে দালাল সিন্ডিকেট থাকার কথা স্বীকার করে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (উপ-পরিচালক) ডা. মো. মাহবুব হোসেন বলেন, হাসপাতালের শুধুমাত্র এক্স-রে মেশিন ছাড়া সকল চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সচল রয়েছে। চেষ্টা করছি আমরা এই সিন্ডিকেটে জড়িতদের আটক করার জন্য। এতে যদি হাসপাতালের স্টাফও জড়িত থাকে তাদেরকে আইনে আওতায় আনা হবে। এক্ষেত্রে আপনাদেরও ভূমিকা রয়েছে আমাদের সহযোগিতা করার।

এ বিষয়ে রংপুর বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা পরিচালক ডা. এবিএম আবু হানিফ বলেন, এটা অবশ্যই আমাদের কাম্য নয়। দালালমুক্ত হাসপাতালের লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জড়িতদের আটক করে পুলিশে সোপর্দ করার জন্য হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে বলা হয়েছে। সেবা নিতে এসে রোগীরা কেন হয়রানি হচ্ছে বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।