ঢাকা Friday, 29 March 2024

১২ হাত দোচালা টিনের ঘরে ২০০ শিক্ষার্থীর পাঠদান

গাইবান্ধা প্রতিনিধি

প্রকাশিত: 19:20, 7 March 2023

১২ হাত দোচালা টিনের ঘরে ২০০ শিক্ষার্থীর পাঠদান

ভাঙা নড়বড়ে ১২ হাত দোচালা টিনের ঘর। দরজা-জানালা নেই। বেঞ্চ আছে মাত্র কয়েকটি। সেগুলোও নড়বড়ে। টিনশেডের ঘরে চারদিকে গাছ। সামান্য বাতাস হলেই যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। ঘরটির অবস্থানও রাস্তা ঘেঁষে। জীর্ণ-শীর্ণ এই ১২ হাত ঘরের তিন রুমে চলছে ২০০ শিক্ষার্থীর পাঠদান। 

এই চিত্র গাইবান্ধার ফুলছড়ি সদরের দক্ষিণ বুড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। স্কুলভবনটি নির্মাণে ২০২১-২২ অর্থবছরে এলজিইডির অধীনে অবকাঠামোগত দক্ষতা উন্নয়ন ও তথ্যের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সহনশীলতা বৃদ্ধি (প্রভাতি) প্রকল্পে মাধ্যমে কাজের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

কাজটি পায় ঢাকার সোনারগাঁয়ের শামীম আহম্মেদ মন্ডল নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠান স্থানীয় ঠিকদার কাদের ভূইয়া আকাশের সঙ্গে কাজটি সম্পাদনের চুক্তি করে। স্কুলভবনটির কাজ শুরু হয় ২০২১ সালের ২০ ডিসেম্বর। ভবনটির কাজ শেষ হওয়ার কথা চলতি বছরের ১৯ জুন। 

কিন্তু ১৫ মাসে স্কুলভবনটির কাজ ৩০ ভাগও শেষ করতে পারেনি ঠিকাদার। ডিজাইনের সঙ্গে স্পেসিফিকেশন মিল না থাকার কারণ দেখিয়ে দেড় মাস থেকে ভবনের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন ঠিকাদার। কবে ভবনের কাজ শেষ হবে তা নিয়ে শঙ্কিত শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।

সরেজমিন দেখা যায়, গাইবান্ধা শহর থেকে ফুলছড়ির সদরে ঢোকার পাশেই দক্ষিণ বুড়াইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অবস্থিত। রাস্তার পশ্চিম পাশ ঘেঁষে একটি দোচালা টিনের ঘর। রাস্তার ওপর শিক্ষার্থীদের হইচই। দোচালা ১২ হাত টিনের ঘরটিতে তিনটি রুম। বসে পড়ার মতো কোনো পরিবেশ নেই। দেখে মনেই হবে না এটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। রুমের ভেতর শিক্ষার্থীরা উচ্চ স্বরে হইচই করছেন। এরই মধ্যে শিক্ষক রুমে ক্লাস নিচ্ছেন। ঘরের সামনে দাঁড়ানোর জায়গা নেই রাস্তা ছাড়া। রাস্তার পূর্ব পাশেই নতুন ভবনের পিলার দাঁড়িয়ে আছে। ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে রেখেছেন। শিশু শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের ক্লাস চলছে। পাশেই প্রধান শিক্ষকের বাড়ির রুমের বারান্দায়।

পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুইটি আকতার বলেন, স্কুলের জায়গায় নতুন ভবন কাজ শুরু সময় থেকে এই টিনশেডের ঘরে আমাদের ক্লাস হচ্ছে। ছোট একটু ঘরে তিনটি রুম। রুমগুলো চার হাত করে। দুই থেকে তিনটি বেঞ্চ বসে। শিক্ষকরা ক্লাসে গেলে সবাই আমরা বেঞ্চে বসতে পারি না। অন্য রুম থেকে শব্দ আসে। পড়ার মনোযোগ হারিয়ে যায়। 

আরেক শিক্ষার্থী রিফা বলেন, স্যারেরা বলছিল আগামী জুনের মধ্য কাজ শেষ হবে। কাজ শুরুর অনেকদিন হয়ে গেলেও এখনো শেষ হয়নি। রুম না থাকায় আমাদের পড়াশোনা হচ্ছে না।

চতুর্থ শ্রেণীর সৈকত মিয়া বলেন, আগে যেভাবে ছিল, তখই ভালো ছিল। নতুন ভবন করতে গিয়ে রুম না থাকায় আমাদের পাঠদান সঠিকভাবে হচ্ছে না। 

স্কুলটির সহকারী শিক্ষক মমতা রানী বলেন, নতুন ভবনের জন্য স্কুলের জায়গা ছেড়ে দিয়েছি। ভবনের কাজ অনেক আগে শুরু হলেই এখন পর্যন্ত পিলার ছাড়া কিছুই হয়নি। ভবন না থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠদান নিয়ে চিন্তায় আছি। কয়েক হাত একটি ঘরে তিনটি রুম করে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলছে। রুম না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে আসছে না। 

আরেক সহকারী শিক্ষক আব্দুস সোবাহান বলেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ছোট একটি টিনশেড রুমে ক্লাস নিচ্ছি। শিক্ষার্থীদের বসার জায়গা দিতে পারছি না। জায়গা সংকটের কারণে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে আসে না। স্কুলে আসার জন্য তাদের চাপও দেয়া যাচ্ছে না। এত শিক্ষার্থীকে আমরা বসার জায়গা দিতে পারছি না। ক্লাসে ঢুকতেও ভয় হয়। রাস্তার সঙ্গেই টিনশেড ঘরে পাঠদান দিচ্ছি। রাস্তা দিয়ে প্রতিনিয়ত গাড়ি চলাচল করছে। যে কোনো শিক্ষার্থী গাড়ির নিচে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। 

অভিভাবক লিপি রানী বলেন, ‘স্কুলের ঘর নাই। ধুলা-বালু, ছোট তিনকোনা রুম। সেজন্য ছোলপলেরা স্কুল আসতে চায় না। মাস্টাররা প্রতিদিন স্কুলে আসার জন্য ডাকপের যায়। ছোলপলগুলো স্কুলে আসে আনন্দ পায় না। স্কুলের সময় হলেই ছোল অন্য একজায় লুকে থাকে। ঘরের কাম করা বাদ দিয়ে ওমরা তাশরা শুরু করছে।’ 

স্কুলের সভাপতি অনিল কুমার বর্মন বলেন, স্কুলটির ভবনের জন্য আমরা জায়গা ছেড়ে দিয়েছি। ১৫ মাস অতিবাহিত হলেও কাজটি দৃশ্যমান হয়নি। এখানে ঠিকাদারের না ইঞ্জিয়ারের গাফিলাতি - কিছু বুঝতে পারছি না। কাজটি আবার গত ২২ দিন থেকে বন্ধ রেখেছেন ঠিকাদার। এই বিষয়ে এলজিইডির নির্বাহীকে বারবার অবগত করার পরও কোনো সুরাহা পাচ্ছি না।

প্রধান শিক্ষক শামসুজোহা মিয়া প্রধান বলেন, স্কুলের ভবন হলে ক্লাসরুমের সংকট কাটবে। এ ভেবে আমরা স্কুলের জায়গা ছেড়ে দিয়ে পাশেই স্থানীয়দের সহযোগিতায় ও স্লিপের টাকা দিয়ে একটি ১২ হাত দোচালা টিনের ঘর করি। শিক্ষার্থীদের যাতে পড়াশোনার ক্ষতি না হয়। ভবন নির্মাণের ঠিকাদার শুরু থেকেই ধীরগতিতে কাজ করতে থাকেন। ঠিকাদার আবার বেশ কিছুদিন থেকে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন গরমের সময় শিক্ষার্থীদের খোলা আকাশের নিচেও পাঠদান করাতে পারছি। সামনে বর্ষা এলে কিভাবে পাঠদান করব। সেই চিন্তায় মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষকরা। কাজটি দ্রুত সম্পূর্ণ করার জন্য উপজেলা-জেলা ইঞ্জিনিয়ার অফিসে বারবার ধরনা দিয়েও কোনো অগ্রগতি হয়নি। কবে নাগাদ এই ভবনের কাজ শেষ হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছি না।

এ বিষয়ে ঠিকাদার কাদের ভুইয়া আকাশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কাজের ডিজাইনের সঙ্গে স্পেসিফিকেশনের মিল না থাকার বিষয়টি আমি এলজিইডির নির্বাহীকে বহুবার বলছি। উনি ঠিক করে দেননি। আমি লস করে কি কাজ করবো। এজন্য কাজটি করতে দেরি হচ্ছে। ডিজাইনের সঙ্গে স্পেসিফিকেশন ঠিক করে দিলেও আমি স্কুলের ভবনটির কাজ দ্রুত শুরু করব।

গাইবান্ধা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ছাবিউল ইসলাম বলেন, কাজটি দ্রুত সময়ে শেষ করার জন্য আমি ঠিকাদারকে বলছি। তারপরও বাজারে জিনিসপত্রের দাম অনেক বেশি। এজন্য ঠিকাদার কাজটি দ্রুত করতে পারছে না। দেখি কাজটি যতদূর সম্ভব দ্রুত শেষ করা যায়।